মসনদ-এ-আলা-ঈশা খাঁ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গৌরব
তিনি ১৯৩৫-৪০ সালের মধ্যে(১)পৃঃ-১৫) সরাইলে তাঁর পিতা দেওয়ান সুলাইমান খাঁ’র (কালিদাস গজদানী) প্রাসাদ বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫৯৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলার কত্রাবুতে (নবীগঞ্জ) মতান্তরে এগারসিন্ধু দূর্গের অদূরে বখতিয়ারপুরে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।(১,২,৩,৪)
১৫৪৮ সালে তাঁর পিতা সুরিবাহিনীর হাতে নিহতহলে শিশু-কিশোর ঈশা খাঁ ও ঈসমাঈল খাঁকে সুরিবাহিনীর সেনাপতিরা বন্দী করে একই রানী সওদাগরের নিকট কৃতদাস হিসাবে বিক্রী করে দেয়। ১৫৬৩ সালে চাচা কুতুবউদ্দিন খাঁ বহু অর্থের বিনিময়ে তাঁদের মুক্ত করে আনেন। এরপর তাঁর চাচার চেষ্টায় ঈশা খাঁ ফিরে পান সরাইলের জমিদারি। বাংলার আফগান শাসক তাজখাঁ কররানীর অনুগ্রহে ১৫৬৪ সালে ঈশাখাঁ সোনারগাঁও ও মহেশ্বরদি (পলাশ উপজেলা) পরগনার ভূমিলাভ করেন। এর ফলে ঈশাখাঁ কররানী শাসকদের অধিনস্থ ভেসেল জমিদার নিযুক্তহন। ১৫৬৫ সালে তাজ খাঁ তাঁকে পিতার বিভিন্ন জায়গির গুলি ফেরত দেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তাজখাঁ কররানীর আগ্রাসিযুদ্ধে ঈশা খাঁর পিতা সুলাইমান খাঁ নিহত হন।সর্ব প্রথম সরাইলে ঈশাখাঁ একটি শাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন। ইতিমধ্যে তিনি বাংলার বার ভুঁইয়াদের ও অবিসংবাদিত নেতাহিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ব্রিটিশ পর্যটকরা লফ্ফিটচ তাঁর এক গ্রন্থে লিখেছেন-গ্রামিন বাংলার রাজাদের প্রধান রাজা ঈশাখাঁ। তিনি খ্রীষ্টানদের বন্ধু।” ঈশা খাঁ এক অভিযান চালিয়ে এগার সিন্ধু (কিশোরগঞ্জেরপাকুন্দিয়াউপজেলা) দখল করেন (এটা তাঁর জীবণের সর্ব প্রথম যুদ্ধ)। ১৫৭৮ সালে মুঘল সুবেদার খানজাহানের নের্তৃত্বে ভাটি অঞ্চলের জমিদারদেরও বিরুদ্ধে এক দূর্দান্ত অভিযান চালান। ঈশাখাঁর সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করে ভাটি অঞ্চলের কিছু জমিদার মুঘলদের পক্ষ অবলম্বন করে।কিন্তু ঈশাখাঁ অদম্য সাহস নিয়ে কাসতুল( কিশোরগঞ্জজেলা) সরাইল জোয়ান শাহী সিমান্তে ধামাউড়া এলাকায় মেঘনাতীকে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ মোকাবেলা করে মুঘল বাহিনীকে পরাজিতকরেন। ১৫৮১ সালে তিনি তাঁর শাসন কেন্দ্র সরাইল থেকে সোনারগায়েঁ স্থানান্তর করেন। মুঘল সেনাপতি শাহবাজখাঁ ১৫৮৩ সালে অতর্কিত এক আক্রমন করে ঈশাখাঁ’র বখতিয়ার পুরদূর্গটি ধ্বংস করে দেন। এরপর ঈশা খাঁ শাহবাজখাঁ’র সাথে টোকে এবং তার সুনখানের সাথে বাজিতপুর যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে; উভয় যুদ্ধে মুঘলবাহিনীকে পরাজিত করেন। কাবুলি এগারসিন্ধু যুদ্ধে ১৫৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঈশা খাঁ ও মাসুম খাঁ মুঘল সেনাপতি শাহবাজখাঁ কে পরাজিত করেন। একই বছর মুঘল বাহিনী পুনরায় ঢাক, বিক্রমপুর, সোনারগাঁও, অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ঈশাখাঁ সেনারগাঁও থেকে নিরাপত্তার কারনে প্রশাসনিক কেন্দ্র কত্রাবুতে স্থানান্তর করেন। ১৫৮৫ সালে কোচ রাজারাম হাজরাও লক্ষণ হাজরাকে পরাজিত করে জংগলবাড়ীদূর্গ( কিশোরগঞ্জেরকরিমগঞ্জ) দখল করেন। ত্রিপুরার রাজা অমর মানিক্যে ও সাথে ঈশা খাঁ’র অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক ছিল। ঈশাখাঁ ১৫৫৭ সালে উদয় পুরের অমর দীঘি খননকালে একহাজার শ্রমিক পাঠিয়ে রাজাকে সাহায্য করেন। দিল্লীর সম্রাট আকবর১৫৯৪ সালের১৭মার্চ তাঁর সুদক্ষ সেনাপতি মানসিংহকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। ১৫৯৭সালের ৫ই সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর হতে প্রায় ৩৬ মাইল উত্তরে মেঘনা নদীতে ও নদীর তীরে প্রচন্ড একজল ও স্থল যুদ্ধে ঈশা খাঁ ও মাসুম খাঁ কাবুলি মুঘল সেনাপতি মানসিংহকে চরমভাবে পরাজিত করেন। এযুদ্ধে মান সিংহের পুত্র সেনাপতি দুর্জন সিংহ নিহত হন এবং মুঘল বাহিনীর অনেক সৈন্য আহত-নিহত ও বন্দী হয়। ষষ্ঠদশ শতাব্দির মাঝামাঝি রচিত এককাব্যে সম্রাট আকবরের কন্ঠে উক্তযুদ্ধ সম্পর্কে সরস বর্ণনা রয়েছে।
কহ মানসিংহ রায় গিয়াছিলা বাংলায় //কেমন দেখিলা সেই দেশ //কেমন করিলা রণ কহ তার বিবরন //নাজানি পাইলা কত ক্লেশ ।।
মুঘল সম্রাট আকবর সমগ্র উত্তর ভারত, এমন কি আফগানিস্তানের বিশেষ অংশ পর্যন্ত দখল করেছিলেন। কিন্তু ঈশা খাঁর প্রবল প্রতিরোধের কারনে ভাটি বাংলায় বারবার মুঘলবাহিনী পরাজিত হয়েছে। ১৫৯৭ সালের যুদ্ধেপরাজিত হয়ে সম্রাট আকবর কৌশলী সমঝোতার পথ অবলম্বন করলেন। তিনি ঈশা খাঁকে দিল্লী অহ্বান করলেন। সম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে ঈশাখাঁ সমভিব্যাহারে দিল্লী গিয়ে সম্রাটের সাথে সাক্ষাত করলেন। তখন একসমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে ঈশা খাঁ কেদেওয়ান ও মসনদ-এ-আলাউপাধি সহ ২৪ টি পরগনার শাসন ক্ষমতা প্রদান করেন। (মতান্তরে, ঈশা খাঁ নিজেই মসনদ-ই-আলা উপাধিগ্রহণ করেন (৩)। পরগনাগু লিহল -আতিয়া/আটিয়া, কাগমারি, বড়বাজু, শেরপুর, জোয়ানশাহি, আলাপসিংহ, ময়মনসিংহ, জাফরসিংহ, নাছিরুজিরাল, খালিয়াজুরি, গংগামন্ডল, পাইকুরা, বরদাখাত/বলদাখাল, স্বর্ণগ্রাম, বরদাখাতমন্দ্রা, হুসাইন শাহী, ভাওয়াল, মহেশ^রদি, কাতরার, কুরিখাই, জোরহুসাইনপুর, সিংদা, দরজিবাজু, হাজরাদি।
চৌকস মুঘল বাহিনীর অগ্রাসী আক্রমন প্রতিরোধ করে মসনদে-আলা দেওয়ান ঈশা খাঁ ও তাঁর পুত্র দেওয়ান মুসা খাঁ দীর্ঘ ৪৮ বছর ভাটি বাংলার স্বাধিনতা সমুন্নত রাখেন। এটা এ অঞ্চলের মানুষ তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাসীর জন্য একটি বড় গৌরব ও গর্বের বিষয়।
গ্রন্থনাঃ মোঃ নিয়াজুল হক কাজল, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক।
লেখক ও গবেষক।নবীনগর,ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
তথ্যসূত্রঃ ১/সরাইল পরগনার ইতিহাস-ড.শাজাহান ঠাকুর।২/ ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলা-মোঃ মোশারফ হোসনে শাহজাহান।৩/বাংলা পডিয়িা।৪/উইকিপিডিয়িা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন